বর্তমান পৃথিবীতে দুর্নীতিমুক্ত দেশ খোঁজে পাওয়া যেখানে দুষ্কর সেখানে আমাদের দেশের রয়েছে টানা পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ান হওয়ার রেকর্ড। ক্ষমতার সংস্পর্শে থাকলে স্বল্প ও মাঝারি আকারে দুর্নীতি হবে- এই বিষয়টাকে অনেক আগে থেকেই দেশের সাধারণ মানুষ পুণ্য হিসেবেই ধরে নিয়েছেন, মেনে নিয়েছেন এটাই সমকালীন বাস্তবতা।

বেশ কয়েক বছর আগে আমার নিজের দেখা দুর্নীতির একটি ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করছি। পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সূচনা ১৯৯০ সালেই ২রা আগস্ট। এটাকে আবার অনেকেই আবার কুয়েত যুদ্ধও বলে থাকেন। যার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটে ১৯৯১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি। সরকারি চাকুরি করার সুবাধে বিশ্বের বিভিন্ন থেকে আসা মানুষজন কুয়েতে অবস্থান করছিলেন, যুদ্ধকালীন সময়ে তারা কুয়েত ত্যাগ করেন। এতে তারা অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েন।

যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের অর্থায়নে কুয়েত সরকার ঘোষণা দিল যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগ পর্যন্ত যারা কুয়েতে ছিলেন তাদেরকে পাঁচ হাজার ইউএস ডলার করে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হবে। সেই আলোকে নিজ নিজ দূতাবাসের মাধ্যমে তাদের ব্যাংক একাউন্টসহ নাম এবং একজন নমিনির নাম-পরিচয় তালিকাভুক্তি করা হয়। এর মধ্যে যুদ্ধ শেষ হবার বছর দুয়েকের মধ্যে যারা কুয়েত ত্যাগ করেছিলেন তারা ফের নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগদান করেন। বছর তিনেকের পর জাতিসংঘের ঘোষিত সেই আর্থিক অনুদান পর্যায়ক্রমে বিতরণ করা শুরু হলো। সেই আর্থিক অনুদান খুব সহজভাবে বিভিন্ন দেশের ভুক্তভোগী গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে গেলেও ব্যতিক্রম ঘটে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে। আমাদের দেশের জনশক্তি ব্যুরো অফিসের কর্তব্যরত অফিসারদের পকেট গরম হয়ে যাবার কারণে সঠিকভাবে সেই অনুদান বন্টন সম্ভব হয়নি।

একটা কথা জানিয়ে রাখি- ‘জাতিসংঘের ঘোষিত সেই অনুদান দুই কিস্তিতে তারা প্রদান করেছিল। কুয়েতের সংশ্লিষ্ট অফিস থেকে একজন গ্রাহকের নামে অনুদানের টাকা ইস্যু করার সাথে সাথে নিজ নিজ দেশের দূতাবাসের কাছে ঐ সকল ব্যক্তির ফাইলটি প্রেরণ করে দেয়া হতো। এরপর বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে ঢাকা জনশক্তি ব্যুরো অফিসে ফাইলগুলো পাঠিয়ে দেয়া হতো। জনশক্তি ব্যুরো অফিস সিরিয়াল নম্বরের মালিক অথবা নমিনির কাছে নির্ধারিত চেক প্রদান করার কথা।’ কিন্তু আমরা কি দেখলাম, বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ যখন তাদের প্রাপ্য অনুদানের চেক নিতে আসেন তখন জনশক্তি ব্যুরো অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ তাদের নিজস্ব দালালদের মাধ্যমে একটি সিন্ডিকেট করে সেই মানুষের অসহায়ত্বকে পূজি করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফন্দি করেছিল। যার ফলে মানুষের ভোগান্তির শেষ ছিল না।

আমার আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যেও কয়েকজন যুদ্ধের আগে কুয়েতে ছিলেন এবং জাতিসংঘের ঘোষিত পাঁচ হাজার ইউএস ডলার প্রাপ্তির তালিকায় ছিলেন। যখন তাদের কাছে একটি সিরিয়াল নম্বরসহ ম্যাসেজ এসেছিল। ম্যাসেজে বলা হয়- ঢাকা জনশক্তি ব্যুরো অফিসে নিজে অথবা নমিনি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেলে অনুদানের নির্ধারিত টাকার চেক গ্রহণ করতে পারবেন। সেই সময় জনশক্তি ব্যুরো অফিসের সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মানুষজন কি পরিমাণ ভুক্তভোগী বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, সেই খবর নিশ্চয়ই তখনকার সময়ে কুয়েত ফেরৎ সকল পরিবারের না জানার কথা নয়। বিস্তারিত ঘটনা লিখলে লেখাটা অনেক লম্বা হয়ে যাবে তাই পাঠকের সুবিধার্থে একটি উদাহরণ দিয়ে লেখাটি শেষ করছি।

নিজের ব্যবসার প্রয়োজনে বছর তিনেক আগে আমি ঢাকায় স্থায়ীভাবে ছিলাম। কুয়েত ফেরৎ আমার আত্মীয়-স্বজন যারা ছিলেন জাতিসংঘের ঘোষিত অনুদানের টাকা গ্রহণ করতে যখন জনশক্তি ব্যুরো অফিসে যেতেন তখন আমাকে সাথে করে নিতেন। হয়তো আমি ঢাকায় থাকার সুবাদে স্বজনরা আমাকে সাথে নিয়ে পাওনা অনুদানের চেক আনতে হবে পূর্ব প্রস্তুতি নেন। প্রথম যেদিন আমি জনশক্তি ব্যুরো অফিসে গেলাম, দেখলাম শত শত মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে ডেস্কে বসা অফিসারদের কাছে কতভাবেই না ধর্না দিচ্ছেন। তবে দুঃখের বিষয় তবুও তাদের কোন কাজ হচ্ছে না।

কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি ভিন্ন রকম বিষয়টি খেয়াল করলাম। চোখে পড়ল জনপ্রতি কমপক্ষে দশ থেকে পঁচিশ ত্রিশ হাজার টাকা চুক্তি হচ্ছে, আবার অনেকেই দালালদের হাতে কাগজপত্র দিয়ে অসহায়ত্ববোধ করছেন। এসব দেখে আমি নিজে সিদ্ধান্ত নিলাম টাকা না দিয়ে কি পাওনা চেক গ্রহণ করতে পারি। অনেক দিন ধরে ঢাকায় আছি তাই একটু ভাব নিলাম। চোখের উপরে বসালাম কালো চশমা, হাতে পরলাম হাফ গ্লাভস। এর সাথে এক হাতে হ্যালমেট আর অন্য হাতে মোটরবাইকের চাবি ঝুলিয়ে ধরলাম। বুক পকেটে সেবা কোম্পানির ইয়া মোটা মোবাইল ফোনের মাথা দেখা যাচ্ছে (তখন শুধু ঢাকা শহরে সেবা কোম্পানির মোবাইল ফোন ছিল)। আমি যদিও বুঝাতে চাইলাম যে আমি ঢাকা শহরে থাকি। কিন্তু আমার হাব বাব দেখে অফিসার বা তাদের দালালদেরও বুঝতে অসুবিধা হলো না আমি সিলেটি হলেও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা শহরে বসবাস করি।

আমার এই কৌশলটা কিছুটা হলেও কাজে লেগেছে। কর্তব্যরত অফিসারকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে বললাম, ‘অফিসার সাহেব, এই নামের চেকটি আপনি একটু দেখেন তো ভাই।’ অফিসার আমাকে বললেন চেয়ারে বসার জন্য। এরপর তিনি একটি লিস্ট বের করে আমাকে বললেন, তাদের কাছে যে লিস্ট আছে এর মধ্যে আমার দেয়া ফাইলের কোন নামগন্ধও নেই। তার এই কথার মানে হলো- কুয়েতস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের অনুদানের তালিকায় আমার নাম নেই। কিন্তু আমার কাছে কনফারমেশন কাগজ আছে। ঢাকায় জনশক্তি ব্যুরো অফিসে যাওয়া মাত্র প্রাপক অথবা নমিনির কাছে নির্ধারিত টাকার চেক গ্রহণ করতে পারবে।

আমি অফিসারকে বললাম, যেহেতু আমার কাছে কনফারমেশন চিঠি আছে। আমি তো চেক না নিয়ে আজকে এখান থেকে যাবো না। আমাদের মধ্যে মোটামুটি যুক্তিতর্ক চলছে। এমন সময় দুইজন লোক এসে আমাকে বললো, ভাই আপনি একটু এদিকে আসেন (তারা এখানকার দালাল আমি ওখানে যাওয়ার পর থেকেই তাদের মতিগতি লক্ষ করেছি)। আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় থাকেন? (আমি তখন ক্যান্টনমেন্ট উত্তর কাফরুল থাকতাম এবং ক্যান্টনমেন্ট রেসিডেন্ট কার্ডও আমার কাছে ছিল )। আমি তখন রাদেরকে কিছু না বলে আমার রেসিডেন্ট কার্ডটি তাকে দেখালাম, বুঝতে পারলাম কাজ হয়েছে। কার্ড দেখার পরে তারা আমাকে বললো, দেখেন আপনি ঢাকা শহরে থাকেন। আমাদেরকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য কিছু টাকা দিয়ে দিবেন আর আমি আপনার কাজটি করে দিচ্ছি। জিজ্ঞেস করলাম মিষ্টি খাওয়ার জন্য কতো টাকা দিতে হবে? উত্তরে বলল, হাজার পাঁচেক। তারপর আমি বললাম, পাঁচ হাজার টাকার মিষ্টি খেলে তো আজ রাতেই তোমরা পটল তুলবা। পরে আরও অনেক তর্ক বিতর্ক শেষে বললাম, ঠিক আছে কাজ করে দাও। আমি তোমাকে মিষ্টি খাওয়ার জন্য টাকা দিচ্ছি। তখন ওই দালাল বলল, আপনাদের ফাইল আমাকে দিয়ে যান আর ঘন্টা দুয়েক পরে আসেন।

দুই ঘন্টা পরে গেলাম দেখি ঠিকই আমাদের চেক রেডি। কোন কথা ছাড়াই ওই অফিসার প্রাপকের নমিনিকে বললেন, আপনি এখানে একটি দস্তখত করেন। দস্তখত শেষে ফাইল সমেত চেকটি আমাকে বুঝিয়ে দেন ওই অফিসার। এরপর অফিসারের রুম থেকে বের হতেই পথরোধ করে দাঁড়ালো ওই দালাল। সে বলল, আপনার চেক পাইলেন, এবার আমাদের মিষ্টির টাকাটা? আমি বললাম, হ্যাঁ, মনে আছে। পকেট থেকে এক হাজার টাকা তাকে দিয়ে বললাম, আপনি একা না আপনার পুরো পরিবারকে নিয়ে মিষ্টি খেয়েন। তখন সে চিৎকার করে বলল, ভাই পরিবারতো অনেক পরে, আরও অনেককে নিয়েই মিষ্টি খেতে হবে। আপনি আরো এক হাজার টাকা দেন? এরপর আমি আর কথা না বাড়িয়ে আরও পাঁচশত তাকে দিয়ে দিলাম।

অনেককেই দেখতেছি অসহায় অবস্থায় দালালের পিছু পিছু হাঁটচছেন। কারণ দালালচক্র কৌশলে সব কাগজপত্র তাদের কাছে নিয়ে বড় অংকের টাকা দাবি করছে। এর মধ্যে একজনকে দেখে পরিচিত মনে হলো। ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম, আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়? জবাব পেলাম, বিয়ানীবাজারের শেওলায়। আমিও তখন বললাম, আমার বাড়ি মাথিউরায়। কাগজপত্র কোথায়? উত্তরে তিনি বললেন ওদের (দালালের) কাছে। আমি বললাম, ওরা তো অনেক বেশী টাকা চাইবে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারবো। চলেন, ওদের কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে আসি। উত্তরে বললেন, যা হবার হবে একঘাট থেকে ছাড়িয়ে আরেক ঘাটে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। যাইহোক এরপর উনাকে অনেক কথা বললাম, কিছুতেই রাজি করাতে পারলাম না।

সন্ধ্যার দিকে ক্যাপিটাল হোটেলের রেস্টুরেন্টে ভদ্রলোকের সাথে আবার দেখা। জিজ্ঞেস করলাম, কি অবস্থা আপনার? তখন ভারাক্রান্ত মনে দালালদেরকে ৩২ হাজার টাকা দিয়ে চেক আনতে হয়েছে। আমি বললাম, আমরা তো ১৫০০ টাকা দিয়েছি। আপনাকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিলাম আপনি তো সুযোগ দিলেন না। উত্তরে তিনি সত্যি কথা বলে দিলেন, আসলে আমিও আপনাকে বিশ্বাস করতে পারিনি।

এরপরে অনেক বার অন্য আত্মীয় বা প্রতিবেশীদেরকে নিয়ে জনশক্তি ব্যুরো অফিসে চেক আনতে গিয়েছিলাম। কোন কথা না বলে দেড় হাজার টাকা দালালের হাতে দিয়ে চেক নিতে হয়েছিল।

রাষ্ট্রের এমন কোন ডিপার্টমেন্ট নেই যেখানে দুর্নীতি হচ্ছে না। আগেকার দিনে আজকের মতো এভাবে সোস্যাল মিডিয়া ছিল না বলে আমরা অনেক বড় বড় দুর্নীতির কিছুর খবর জানতে পারতাম না। আজকাল সোস্যাল মিডিয়ার কল্যাণে অতি সহজেই ছোট, বড় ও মাঝারি সব ধরনের দুর্নীতির খবর আমাদের চোখে পড়ে। আমরা হয়তো মনে করছি ,দুর্নীতির ব্যবসা নতুন চালু হয়েছে। সত্যি কথা হলো, দেশের জন্মলগ্ন থেকেই দুর্নীতি চলছে। আসলে আমার বিশ্বাস, কোন ভালো পরিবারের ছেলেমেয়েরা কখনও দুর্নীতি করবে না। যতো বড় সুযোগ তার সামনে আসুক তারা সেটা প্রত্যাখ্যান করবে।

একজন রাষ্ট্র প্রধানের জন্য এতোগুলো দুর্নীতিবাজদেরকে কিভাবে সামাল দিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করে এই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন- সেখানে আমার মতো মানুষের কোন কিছু বুঝা বা কোন মন্তব্য করা কোনোটাই সম্ভব নয়।

লেখক- সদস্য, এনআরবি সাপোর্ট গ্রুপ ইউকে।